in

ইনফরমেশন ওভারলোড যেভাবে আমাদের ধ্বংস করছে

Information Overload

ইনফরমেশন ওভারলোড! এখনও মানুষ ঠিক সেভাবে এই শব্দের সাথে পরিচিত নয়। আচ্ছা, শেষ কবে আপনি সব ডিসট্র্যাকশন বন্ধ করে নীরবে, নিজের সাথে একান্তে সময় কাটিয়েছেন?

আধুনিক এই দুনিয়ায় চারদিক জুড়ে ইনফরমেশন ঘুরছে। হাজার হাজার টিকটক ও ইউটিউব ভিডিও, অগণিত ইনস্টাগ্রাম পোস্ট, অনলাইনে ঘোরাফেরা করা লক্ষাধিক বই, পডকাস্ট, নেটফ্লিক্স, বিনোদনময় মুভি-নাটক-টিভি শো সবই আমাদের হাতের নাগালে। এই দুনিয়া থেকে বের হওয়া আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব। আমরা ইনফরমেশনের এই সার্বক্ষণিক চক্রে আটকা পড়েছি। দিনের প্রায় পুরোটা সময় আমরা এভাবেই কাটাচ্ছি। খাওয়ার সময় কোনো ভিডিও দেখছি, পড়তে গেলে কিছু শুনছি,‌ ঘর পরিষ্কার সময় পডকাস্ট ছেড়ে রাখছি, এমনকি বাথরুমেও আমরা ফোন নিয়ে যাচ্ছি যেন তখনও ব্রেইনটাকে স্টিমুলেট করতে পারি। দিনশেষে আমরা সবাই আসক্ততে পরিণত হয়েছি। সবসময় ভয় পাচ্ছি, অনলাইনে না এলে গুরত্বপূর্ণ কি যেন মিস করে বসব।

কিন্তু ইনফরমেশনের এই স্রোত কখনও থামছে না। আমাদের ব্রেইন এতটাই ওভারলোড হয়ে যাচ্ছে যে আমরা ঠিকমতো চিন্তা করতে পারছি না, গুরত্বপূর্ণ কাজে ফোকাস করা যাচ্ছে না। এমনকি এই লেখাটা লেখার সময়েও নানা চিন্তা মাথায় আসছে।

এভাবে ইনফরমেশনের স্রোতে ডুবে থাকার কারণে আমাদের সৃজনশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও আমাদের সৃজনশীলতার ক্যাপাসিটি ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হল আমরা সৃজনশীলতাকে আবাদ করার এবং আইডিয়াকে প্রসেস করার পর্যাপ্ত সময় মনকে দিচ্ছি না। অথচ সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে সৃজনশীলতার নেই কোনো বিকল্প।

আমাদেরকে ফিয়ার অফ মিসিং আউট অর্থাৎ অনলাইনে না গেলে যে আমরা বিশাল কিছু মিস করে ফেলব এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তথ্যের স্রোত থেকে বের হয়ে নিজেদের চিন্তা নিয়ে একাকী ভাবতে হবে, যেকোনো একটি কাজে ফোকাস করা এবং যে সময়গুলোতে আমরা কিছুই করছি না সেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে। এভাবে আমরা সত্যিকারের প্রোডাক্টিভিটি, সৃজনশীলতা এবং মানসিক প্রশান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারবো।

কখন আমরা সবচেয়ে সৃজনশীল হই? যখন আমাদের মাথায় নতুন কোনো ইনফরমেশন না ঢুকে, যখন আমরা শান্তিতে দুনিয়ার নানা বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবি। অনেকের মনেই নানা আইডিয়া আসে গোসলের সময়। কেন? কারণ, তখন আমরা বিক্ষিপ্ত চিত্তে থাকি না। তাই হাস্যকর শোনালেও সত্য, গোসলের এই সময়টা হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্য সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ সময়। ডা ভিঞ্চি এই বিষয়টা বুঝতেন। তাই তিনি তার কর্মের দিকে দীর্ঘ সময় একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন, এ সময় কিছুই করতেন না। আর তার মন কাজ করত ম্যাজিকের মতো।

দুঃখজনক ব্যাপার হল, ইনফরমেশন ওভারলোডের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জানা থাকার পরও আমরা এই বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আজ আমরা গড়ে প্রায় সাত ঘণ্টারও বেশি সময় স্ক্রিনের সামনে কাটাচ্ছি। আর এই সময়টা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা দৈনিক যে পরিমাণ ইনফরমেশন গ্রহণ করছি তা গিগাবাইটের চাইতেও বেশি। তৃষ্ণার্ত কাক যেভাবে পানি পান করে, আমরাও সেভাবে তৃষিত হৃদয়ে তথ্য গিলছি।

ইনফরমেশন ওভারলোড নতুন কিছু নয়। ১৫ শতকে ছাপাখানার আবিষ্কারের পর থেকে বিভিন্ন গবেষকরা বুঝতে পেরেছিলেন, অতিরিক্ত তথ্য আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ বয়ে নিয়ে আসবে। বর্তমান সময়ে ইতিহাসের প্রায় সমস্ত জ্ঞানের অ্যাক্সেস আমাদের কাছে থাকার পরও আমরা এর ফায়দা হাসিল করতে পারছি না। তথ্যের সাগরে হারিয়ে গিয়েছি আমরা।

একটা ওভারলোডেড গাড়ির যে পরিণতি হতে পারে, ইনফরমেশন ওভারলোড একটা মস্তিস্কের সেরকম পরিণতি হতে সাহায্য করতে পারে।

ইনফরমেশন ওভারলোড কিভাবে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছে নিউরোসাইন্স। আমাদের ব্রেনের একটি অংশ হচ্ছে ওয়ার্কিং মেমরি; যা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে কাজ করে এবং আমাদের নানা আচরণে প্রভাব ফেলে। ওয়ার্কিং মেমরি অত্যধিক তথ্য দ্বারা ওভারলোড করে ফেললে এটি আমাদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং কর্মদক্ষতাকে কমিয়ে দেয়।

আমরা অনেকেই নিজেদের প্রোডাকটিভ রাখার জন্য মাল্টিট্যাস্কিং করে থাকি কিন্তু এর দ্বারা প্রোডাক্টিভিটি বাড়ার বদলে বরং প্রোডাক্টিভিটি আরও কমে যায়। কারণ প্রকৃতপক্ষে মাল্টিটাস্কিং বলতে কিছু নেই। এ সময় আমাদের ব্রেইন দুটো কাজের মধ্যে খুব দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করে। অর্থাৎ, একটা কাজ একটু করে আবার আরেকটা কাজ করে। এটা কেবল আমাদের কর্মদক্ষতায় কমায় না বরং মানসিকভাবেও ক্লান্ত করে তোলে। মাল্টিটাস্কিংয়ের কারণেও ইনফরমেশন ওভারলোড হয় যা আমাদের স্ট্রেস বৃদ্ধি করে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

তাই প্রডাক্টিভিটি যদি বৃদ্ধি করতেই হয় তাহলে সতর্কতার সাথে মাল্টিট্যাস্কিং থেকে বেঁচে থাকতে হবে। নিজেকে যেকোনো একটি কাজে গভীর মনোযোগের সাথে নিয়োজিত রাখতে হবে। এমআইটির একজন বিজ্ঞানী আর্ল মিলার (Earl Miller) বলেছেন আমাদের ব্রেইনগুলো মাল্টিট্যাস্কিংয়ের জন্য উপযুক্ত নয়।

আমাদেরকে ফিয়ার অফ মিসিং আউট (FOMO) অর্থাৎ অনলাইনে না গেলে যে আমরা বিশাল কিছু মিস করে ফেলব এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তথ্যের স্রোত থেকে বের হয়ে নিজেদের চিন্তা নিয়ে একাকী ভাবতে হবে, যেকোনো একটি কাজে ফোকাস করা এবং যে সময়গুলোতে আমরা কিছুই করছি না সেই সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে। এভাবে আমরা সত্যিকারের প্রোডাক্টিভিটি, সৃজনশীলতা এবং মানসিক প্রশান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারবো।

What do you think?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

the-philistine-situation-and-what-we-can-do

ফিলিস্তিন পরিস্থিতি এবং আমাদের করণীয়

emotional intelligence of a muslim wife & women

আবেগিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মুসলিম স্ত্রীর বৈশিষ্ট্য