in

দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার দোয়া: সূরা কাহাফের দশ আয়াত

প্রথম দশ নাকি শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করতে হবে?

Dajjal's Fitnah and Sura Kahf

সূরা আল কাহাফ। এই নামকরণের কারণ সূরার মধ্যে কাহাফ বা গুহাবাসীদের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই সূরার আছে অনন্য মর্যাদা। প্রতি শুক্রবারে এই সুরা তিলাওয়াত করা সুন্নাহ। এমনকি এই সূরার ১০-টি আয়াতও মিথ্যা মাসিহ (মাসিহ আদ-দাজ্জাল)-এর হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারবে। যে দাজ্জালের ফিতনা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ফিতনা।

আবূ দারদা রা. সূত্রে বর্ণিত। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যে ব্যক্তি সূরা আল-কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্তি পাবে। [সুনানু আবু দাউদঃ ৪৩২৩]

অন্য বর্ণনায় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

সূরা কাহাফের শেষ অংশ, (যার মুখস্থ থাকবে, সে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা পাবে।) [সুনানু আবু দাউদঃ ৪২৭২]

অনেকের মনে হতে পারে, কীভাবে এই সূরা দাজ্জালের হাত থেকে বাঁচাবে? তা ছাড়া, প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করতে হবে, না শেষ দশ আয়াত? যেহেতু দুটো করারই আদেশ দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ।

আন নববি রাহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,

এটা হওয়ার কারণ, এই [সুরার] শুরুতে বিভিন্ন বিস্ময় ও নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। যে এগুলো নিয়ে তাদাব্বুর (গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা) করবে সে দাজ্জালের ফিতনায় পথভ্রষ্ট হবে না। শেষ দশ আয়াতের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। [শারহুল নববি আলা সহিহ মুসলিমঃ ৮০৯]

সুরা আল-কাহফের শুরুর এবং শেষের দশটি আয়াতে দাজ্জালের ফিতনা বোঝার এবং ফিতনার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। সূরার আয়াতগুলো বাহ্যিকভাবে পাঠ না করে এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলেই আল্লাহর সুরক্ষা মিলবে।

সূরার শুরুতে আল্লাহ গুহার যুবকদের কাহিনী তুলে ধরেছেন। তারা ছিল মুমিন যুবক। তারা শহরে তাদের আরামদায়ক বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল একটি রুক্ষ পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতে। কেন তাদের পালাতে হয়েছিল? কারণ তারা মূর্তির ইবাদত না করে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করত। এ জন্য তারা নিগৃহীত হয়েছিল।

আল্লাহ বলেন,

اِذۡ اَوَی الۡفِتۡیَۃُ اِلَی الۡکَهۡفِ فَقَالُوۡا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً وَّ هَیِّیٴۡ لَنَا مِنۡ اَمۡرِنَا رَشَدًا ﴿۱۰﴾

যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল অতঃপর বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে রহমত দিন এবং আমাদের জন্য আমাদের কর্মকান্ড সঠিক করে দিন’। [সুরা কাহাফঃ ১০]

এই যুবক মুমিনরা হিজরতের মাধ্যমে ইমানের চরম পরীক্ষা দিয়েছিল। আরামের বসতবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে পাড়ি জমিয়েছিল। তাদের এই হিজরতের সাথে রাসুলের সাহাবিদের মদিনায় হিজরত কিংবা ফেরাউনের কাছ থেকে পলায়নরত মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গী বনি ইসরাইলিদের সাদৃশ্য আছে।

দাজ্জাল এলে মুমিনরাও একই পরীক্ষায় পড়বে। যারা আল্লাহর শিরক করবে না, শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে দাজ্জাল তাদের সবাইকে হুমকি দেবে, হত্যা করবে। তখন ইমান নিয়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না।

উম্মু শারিক রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে,

লোকেরা দাজ্জালের আতঙ্কে পর্বতে পালিয়ে যাবে। [সহিহ মুসলিমঃ ২৯৪৫]

আবু সায়িদ খুদরি রা. বর্ণনা করেছেন যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

সে সময় অতি নিকট যখন একজন মুসলিমের সর্বোত্তম সম্পদ হবে ছাগ-পাল। যা নিয়ে সে পাহাড়ের চুড়ায় এবং বৃষ্টির এলাকায় (তৃণভূমিতে) চলে যাবে; সে ফিতনা থেকে স্বীয় দ্বীন রক্ষার্থে পলায়ন করবে। [সহিহ বুখারিঃ ১৯]

তাই যখন আমরা গুহাবাসী তরুণদের ঘটনা পড়ব, তাদের ইমানের উচ্চতা সম্পর্কে ভাবব, তখন স্বাভাবিকভাবেই নিজেরাও জীবনে দীন নিয়ে এরকম ফিতনায় পতিত হলে তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণে আসবে। আমাদের আত্মজিজ্ঞেস করা উচিতঃ দাজ্জাল যদি কালই আত্মপ্রকাশ করে, আমরা কি তাঁর হাত থেকে ইমান হিফাজত করতে পারব? আমাদের ইমান অতটা শক্তিশালী তো? ইমান বাঁচাতে ঘর ছাড়তে পারব তো? নতুন দেশে হিজরত করব? দরকারে বন-জঙ্গল কিংবা পাহাড়ে যেতে পারব?

এরকম নাসিহাহ আমাদের সবসময় দরকার। এতে ইমান চাঙ্গা হয়। আসন্ন ফিতনার জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি থাকে।

সূরা কাহাফের শেষের দিকে পরকালের সবচেয়ে দুর্ভাগাদের কথা বলা হয়েছে। যারা মনে করবে, তারা দুনিয়ার জীবনটা আল্লাহর পথেই কাটিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাদের সব আমল ব্যর্থ করে দেবেন। আল্লাহ বলেন,

اَلَّذِیۡنَ ضَلَّ سَعۡیُهُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ هُمۡ یَحۡسَبُوۡنَ اَنَّهُمۡ یُحۡسِنُوۡنَ صُنۡعًا ﴿۱۰۴﴾

দুনিয়ার জীবনে যাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করছে যে, তারা ভাল কাজই করছে’! [সুরা কাহাফঃ ১০৪]

কি ভয়ানক অবস্থা! এ জন্যই সর্বদা নিজেদের অন্তরের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতে হবে, আল্লাহর কাছে তাওবা-ইসতিগফার করতে হবে। নিজেদের নিয়ে অহংকার করা যাবে না।

দাজ্জাল মানুষের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে। সে মন্দকে ভালো হিসেবে উপস্থাপন করবে, আর ভালোকে মন্দ হিসেবে। সে মানুষকে জান্নাতের পথ দেখাবে, অথচ সেটা হবে জাহান্নামের পথ। আবার মানুষকে জাহান্নামের পথ দেখিয়ে ভয় দেখাবে, কিন্তু বাস্তবে সেটা হবে জান্নাতের পথ।

আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন যে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে এমন একটি কথা বলে দেব না, যা কোন নবীই তাঁর সম্প্রদায়কে বলেন নি? তা হল, নিশ্চয়ই সে হবে কানা, সে সাথে করে জান্নাত এবং জাহান্নামের দু’টি কৃত্রিম ছবি নিয়ে আসবে। অতএব যাকে সে বলবে যে এটি জান্নাত প্রকৃতপক্ষে সেটি হবে জাহান্নাম। আর আমি তার সম্পর্কে তোমাদের ঠিক তেমনি সতর্ক করছি, যেমন নূহ (আলাইহিস সালাম) তার সম্প্রদায়কে সে সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। [সহিহ বুখারিঃ ৩৩৩৮]

মুমিনরা এই পরীক্ষার সম্মুখীন হলে তাদের অবশ্যই আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে আগুনে ঝাঁপ দিতে হবে। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তিনি মুমিনদের এই আগুন থেকে রক্ষা করবেন, যেভাবে তিনি ইবরাহিম আলায়হিস সালামকে তাঁর জাতির হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

হুজায়ফা রা. বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

দাজ্জালের সাথে কি থাকবে, এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত অবগত আছি। তার সাথে প্রবাহমান দুটি নহর থাকবে। একটি দৃশ্যত সাদা পানি এবং অপরটি দৃশ্যত লেলিহান অগ্নি মনে হবে। যদি কেউ সুযোগ পায় তবে সে যেন ঐ নহরে প্রবেশ করে যাকে দৃশ্যত আগুন মনে হবে এবং (এই) চক্ষু বন্ধ করে, মাথা অবনমিত করে সে যেন তা থেকে পানি পান করে। তা হবে ঠাণ্ডা পানি। দাজ্জালের এক চোখ বিকৃত হবে এবং তার চোখের উপরে ঝুলন্ত চামড়া থাকবে এবং দুই চোখের মাঝখানে كَافِرٌ অথবাك ف ر লেখা থাকবে। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল মুমিন ব্যক্তি তা পাঠ করতে পারবে। [সহিহ মুসলিমঃ ৭১০১]

আরেক বর্ণনায় তিনি বলেছেন,

দাজ্জালের বাম চোখ কানা হবে। (তার দেহে) ঘন চুল হবে। তার সাথে জান্নাত ও জাহান্নাম থাকবে। (মুলতঃ) তার জাহান্নাম জান্নাত হবে এবং তার জান্নাত জাহান্নাম হবে। [সহিহ মুসলিমঃ ৭১০০]

সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যা সত্য বানানো শয়তানি কৌশল। তার এই কৌশলের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করবে দাজ্জাল ও তার পথভ্রষ্ট অনুসারীরা।

আল্লাহ বলেন,

تَاللّٰهِ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَاۤ اِلٰۤی اُمَمٍ مِّنۡ قَبۡلِکَ فَزَیَّنَ لَهُمُ الشَّیۡطٰنُ اَعۡمَالَهُمۡ فَهُوَ وَلِیُّهُمُ الۡیَوۡمَ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۶۳﴾

আল্লাহর শপথ, আমি তোমার পূর্বে বহু জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি। অতঃপর শয়তান তাদের জন্য তাদের কর্মকে শোভিত করেছে। তাই আজ সে তাদের অভিভাবক। আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক আযাব। [সুরা নাহলঃ ৬৩]

এরপর প্রশ্ন আসে, শয়তানের কৌশল থেকে বাঁচার মতো দৃঢ় ইমান আছে কি আমার? আমি কি ইমানি শক্তিবলে দাজ্জালের দেখানো জাহান্নামে পা দিতে পারব?

আমরা এখানে সূরা কাহাফ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করলাম, দাজ্জালের সাথে সূরাটির সম্পৃক্ততাও দেখলাম। এই সূরাটি আমাদেরকে পূর্বেকার মুমিনদের ফিতনার মুখোমুখি হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশাপাশি ভবিষ্যতের ফিতনা মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুত করে। যে মুমিনরা এই সূরা থেকে শিক্ষা নিতে পারবেন, শিক্ষাকে বুকের মাঝে গেঁথে নেবেন, তিনিই বড় বড় ফিতনা থেকে মুক্তি পাবেন।

এই কারণেই প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার পুরো সুরাটি তিলাওয়াত করা উচিত। পুরোটা না পারলে অন্তত যেন প্রথম ও শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করি।

নিশ্চয়ই সাফল্য আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, আল্লাহই সর্বজ্ঞানী। **লেখাটি আবু আমিনা ইলিয়াসের (জাস্টিন প্যারট) “Ten verses of Surat al-Kahf to protect from Dajjal”-থেকে অনূদিত।

What do you think?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

netflix to promote lgbt

এলজিবিটি প্রচার ও প্রসারে নেটফ্লিক্স

ইমাম মাহদির আগমন

উম্মাহর খলিফা ইমাম মাহদির আগমন