ইলম অর্জনের গভীরে ঢুকতে পারে কেবল ইলম পিপাসুরাই। ইলমের প্রতি তাদের অসম্ভব ভালোবাসা থাকে। আর এই ভালোবাসার কারণে সবর ও কষ্টও সহ্য করে নিতে হয়। ইলমে ডুবে থাকার কারণে সে জীবিকা উপার্জন করতে পারে না। যেহেতু সে কোনো শাসক বা ধনাঢ্য বন্ধুর সাহায্য নেয় না, তাই দারিদ্র্যতা তার সঙ্গী হয়।
মহান আল্লাহ তাদের ব্যাপারেই বলেছেন,
هُنَالِکَ ابۡتُلِیَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ زُلۡزِلُوۡا زِلۡزَالًا شَدِیۡدًا ﴿۱۱﴾
তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল। আর তারা ভীষণভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল। [সুরা আহজাবঃ ১১]
যখনই অন্তর কোনো ফিতনা বা বিপদের ভয় করে, এটি বলে ওঠেঃ
বিজয়ের রাস্তা সুমিষ্ট ফল খাওয়ার মতো নয়,
বিজয়ের পথ ভীষণ তেঁতো।
আহমাদ ইবনু হাম্বাল যখন ইলম অর্জনের পথে পা বাড়ালেন, তখন তিনি দারিদ্র্যতায় ডুবে ছিলেন। এরপরও তিনি ইলমের রাস্তায় লেগে থাকেন চল্লিশটি বছর। এর মাঝে তিনি বিয়েও করেননি। ইলম পিপাসুদেরও ইমাম আহমাদের মতো দারিদ্র্যতাকে সয়ে নিতে হবে।
কিন্তু কে পারবে তার মতো সইতে? তাকে দেওয়া পঞ্চাশ হাজার দিরহাম তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি আচার আর লবণ খেয়ে জীবনধারণে অভ্যস্ত ছিলেন।
তিনি এমনি এমনি এত সুখ্যাতি আর মর্যাদা লাভ করেননি। তাই কত মানুষ আজও তাকে স্মরণ করে, তার থেকে উপকৃত হয়, তার কবর জিয়ারত করে। তার প্রশংসা দিগন্ত-বিস্তৃত, তার ইলমের সৌন্দর্য জগতকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। আর আখিরাতের প্রাপ্যের ব্যাপারে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো অবগত।
অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, অধিকাংশ আলিমদের কবরই মানুষ চেনে না, তাদের কবরে যায় না। কারণ তারা শাসকদের সাথে আপোষ করেছে, তাদের অনাচারকে বৈধতা দিয়েছে। ফলে ইলমের বারাকাহ তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তারা লাঞ্ছিত হয়। মৃত্যুকালে যখন পৌঁছায় তখন তাদের বুকভরা অনুশোচনা থাকে। তারা যা হারিয়েছে তা চিরকালের জন্যই। কিন্তু যে সুখটুকু তারা জীবনে উপভোগ করেছে তা ক্ষণিকের জন্য, আর পরকালের কষ্ট হবে চিরস্থায়ী।
ইবরাহিম ইবনু আদহাম বলেছেন, যদি রাজা-বাদশারা জানতো আমাদের কি আছে, তাহলে তারা এটা [ইলমের প্রশান্তি] পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে তলোয়ার বের করে লড়াই করত।
তাই বড় কিছু পেতে হলে সবর করতে হবে। কারণ ভোগ-বিলাস, খাহেশাতের অনুসরণ এবং অলসতায় জীবন কাটানো – সবই একদিন ফুরিয়ে যাবে, খালি থেকে যাবে হতাশা।
ইমাম শাফিয়ি রাহ. বলেছেন,
তোমাকে সইতে হবে সবরমাখা দিন,
যার সময়টা স্বপ্নের মতো দীর্ঘ;
হে আত্মা, দুনিয়ার জীবন পরিত্যাগ করো
কারণ [আসল] জীবন সামনে পড়ে আছে।
দারিদ্র্যপীড়িত কোনো আলিম কি ইলম হারানোর বিনিময়ে শাসকের কাছ থেকে সম্পদ গ্রহণ করবে? নিশ্চয়ই নয়।
আলিমরা কোনো জটিল মাসআলার সমাধান বের করলে কিংবা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বের করলে যে আনন্দ পায় তার সাথে দুনিয়াবি কোনো আনন্দের তুলনা হয় না।
যাকে দৈহিক সুখ দেওয়া হয় তাদের অন্যদের মতো জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা থাকে না। অন্যদের মতো তারাও বেঁচে থাকে। তবে তাদের এই বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
পরকালীন জীবনের ব্যাপারে তারা ঝুঁকিতে থাকে, অন্যদিকে আলিম ও ইবাদতগুজাররা থাকে নিরাপদ। তাই বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। অলসতার পরিণতি চিন্তা করে আজই আলস্যকে পরিত্যাগ করুন। অলসতাই মানুষের ধ্বংসের কারণ। অনেক আলিম ইলমের সুবাস পেয়েও পরবর্তীতে গাফিলতির কারণে ইলমের বারাকাহ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আজ তারা কবরে শুয়ে আছেন অনুশোচনা ও দুঃখবোধে।
এক লোক শায়খ ইবনুল জাগওয়ানিকে স্বপ্নে দেখেন। শায়খ তাকে বলেন, ‘তোমাদের সবার মধ্যেই গাফিলতি আছে, আর আমাদের মধ্যে আছে অনুশোচনা।’
তাই গাফিলতি থেকে বাঁচো। আল্লাহ তোমাকে সফলতা দান করুন। কামনাবাসনার শেকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসো। আরাম-আয়েশ আর অলসতায় ডুবে থেকে কিছু অর্জন করা যায় না।
জীবন থাকতেই, মালাকুল মাওত আসার আগেই সব সুযোগকে কাজে লাগাও। দৃঢ় মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে চল।
দুনিয়াকে, দুনিয়াদারদেরকে এড়িয়ে চলো। যারা এখনও দুনিয়ার মায়ায় পড়ে আছে আল্লাহ তাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। যারা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয় তারাই প্রকৃত ধনী।
যেমনটা ইবরাহিম ইবনু আদহাম বলেছেন, ‘যদি রাজা-বাদশারা জানতো আমাদের কি আছে, তাহলে তারা এটা [ইলমের প্রশান্তি] পাওয়ার জন্য আমাদের সাথে তলোয়ার বের করে লড়াই করত।’
পার্থিব দুনিয়ায় নিমজ্জিতরা প্রায়ই হারাম বা সন্দেহজনক উৎস থেকে তাদের জীবিকা অর্জন করে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের অভ্যাস থেকে বিরত থাকলেও তাদের পরিবারের কেউ না কেউ এতে লিপ্ত থাকে। কিন্তু তবুও ইমানি দুর্বলতার কারণে তারা হারাম উপার্জনকারীকে বাধা দেয় না।
তারা বাড়ি বানালে শ্রমিকদের শোষণ করে। টাকা ইনকাম করলে হারামভাবে করে। এদের সবাই খুন, দুনিয়া থেকে অপসারণ কিংবা অপবাদের ভয় পায়।
অন্যদিকে আলিমরা তা-ই খান যা শরিয়ামতে হালাল। তারা কোনো শত্রুকে ভয় পায় না। তারা দুনিয়ায় সম্মানিত হয়, আখিরাতেও আল্লাহ তাদের সম্মানিত করবেন। মানুষ তাদের পাশে যেয়ে বসে, তাদের হাতে চুমু খায়, তাদের প্রশংসা করে। আর আখিরাতেও দুনিয়াদার মানুষদের থেকে আখিরাতমুখী মানুষদের পরিণতি অনেক ভিন্ন হবে, ইনশাআল্লাহ।
কিছু মানুষের অবস্থা থেকে আশ্চর্য হতে হয়। আল্লাহ যাকে ইলমের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যাকে ফিরিশতাসহ সবাই সম্মান করে, সে-ই তার এই মর্যাদাকে অবলুন্ঠিত করে এমন মানুষদের সম্মান দেখিয়ে যাদের মানুষ সম্মান করে কেবল অর্থসম্পদ কিংবা ক্ষমতাবলের কারণে।
আবু ইয়ালা আল-আলাউয়ি বলেছেনঃ
কারো কারো ছিল চর্মরোগ
লুকোনো অগ্নিশিখার মতো
অর্থসম্পদ ঢেকে রেখেছিল তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি
কিন্তু যখন সম্পদ চলে যাবে, তাদের ত্রুটিও বেরিয়ে পড়বে।
আল্লাহ আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দিন। চিন্তা করার তাওফিক দান করুন। আমাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করতে সাহায্য করুন।
কারণ তিনিই নিকটবর্তী (কারিব) এবং প্রতিক্রিয়াশীল (মুজিব)।
**শায়খ ও ইমাম আল-ফারাজ ইবনুল জাওজি রাহিমাহুল্লাহর লেখা অবলম্বনে রচিত। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।
GIPHY App Key not set. Please check settings