in

চিপ যুদ্ধ এবং ভূরাজনীতি; বিপর্যয়ের মুখে বিশ্ব

semiconductor chip war, China USA, the world is in danger

কখনো ভেবে দেখেছেন কোন জিনিসটির কারণে আপনার স্মার্টফোন এত স্মার্ট? কেন আপনার কম্পিউটার এত ফাস্ট ও শক্তিশালী? উত্তরটি লুকিয়ে আছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ নামক ছোট একটি উপাদানের ভেতর। এই অসাধারণ ক্ষুদ্র বস্তুটিই আধুনিক বিশ্বের অদৃশ্য নায়ক। সেমিকন্ডাক্টর আমাদের জীবনকে করেছে আরো সহজ, দ্রুত গতিশীল এবং কানেক্টেড।

সেমিকন্ডাক্টরকে গিরগিটির সাথে তুলনা করা যায় – বৈদ্যুতিক গিরগিটি। গিরগিটি যেমন ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়, তেমনি সেমিকন্ডাকটরও কখনও কখনও পরিবাহীর মতো কাজ করে (বিদ্যুতকে অবাধে প্রবাহিত করতে দেয়) এবং কখনও কখনও অন্তরকের মতো আচরণ করে (বিদ্যুতের প্রবাহকে বাধা দেয়)। এই অনন্য ক্ষমতার কারণে সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর এটাই সমস্ত আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের ভিত্তি।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সেমিকন্ডাক্টর চিপ ছাড়া দুনিয়া কল্পনাও করা যায় না। আমাদের জীবনের বিভিন্ন অপরিহার্য ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ থেকে শুধু করে অতি গুরত্বপূর্ণ মেডিকেল যন্ত্রাংশ, অটোমোবাইল সবকিছুতে লাগছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ। প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে সূচকীয় হারে। সেমিকন্ডাকটর চিপ ইন্ডাস্ট্রি এখন পড়ে গেছে বৈশ্বিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে – চিপ নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে যুদ্ধ। যে চিপের দুনিয়ায় এগিয়ে যাবে, আগামী বিশ্বে সে-ই রাজত্ব করবে। এই যুদ্ধের নাম “Chip War”।

সেমিকন্ডাক্টরের উত্থান

সেমিকন্ডাক্টরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০ শতকের মাঝামাঝিতে, ট্রানজিস্টর আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে। ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট সাধারণত চিপস নামে পরিচিত। কয়েক দশক ধরে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি একটি মাল্টি-বিলিয়ন-ডলার ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়েছে। ইন্টেল, এএমডি এবং তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) এর মতো কোম্পানিগুলো চিপস যুদ্ধের সম্মুখভাগে রয়েছে।

চিপ যুদ্ধ

সেমিকন্ডাক্টর মার্কেটে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির মধ্যে চলছে চরম প্রতিযোগিতা। কেবল প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই নয় এটা। এর সাথে বৈশ্বিক রাজনীতি জড়িত, যার আছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রি শুধুমাত্র কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সের জন্যই চিপস বানায় না, গুরত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণেও রয়েছে এর কার্যকরী অবদান।

চিপ জগতে চীনের আকাঙ্খা

সাম্প্রতিক সময়ে চীন চিপ যুদ্ধে একটি গুরত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। চীনা সরকার তার সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। উদ্দেশ্য, বিদেশী প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং আত্ম-নির্ভরশীলতা অর্জন করা। সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (এসএমআইসি) এর মতো কোম্পানিগুলো এই যুদ্ধের অগ্রভাগে চীনের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যাদের লক্ষ্য এই ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত জায়ান্ট যেমন টিএসএমসি, ইন্টেল, আইবিএমের সাথে প্রতিযোগিতা করা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

সেমিকন্ডাকটর অঙ্গনে চীনের উত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুপ থাকেনি, তারাও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সেমিকন্ডাকটর প্রযুক্তির কৌশলগত গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন সরকার দেশীয় উৎপাদন এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য চিপস অ্যাক্টের (আমেরিকার জন্য সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন করতে সহায়ক প্রণোদনা তৈরি করা) মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে এই প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে। 

তাইওয়ানের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা

তাইওয়ানের ভূমিকা চিপ যুদ্ধে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। কারণ তাইওয়ানে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেমিকন্ডাকটর চিপ নির্মাতা তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি)। তারা গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনের ৮০-৯০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রিতে দ্বীপ রাষ্ট্রটির অবস্থান অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ হওয়ায় এটি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই তাইওয়ানের সেমিকন্ডাকটর ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। এর কৌশলগত গুরত্ব তারা স্বীকার করেছে।

সোভিয়েত বনাম যুক্তরাষ্ট্র

প্রফেসর ক্রিস মিলার তার বই “Chip War: The Fight for the World’s Most Critical Technology” -তে চিপ ওয়ার নিয়ে আলোচনা করেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের প্রযুক্তিগত ব্যবধান ঘুচাতে পারেনি, যদিও তারা এর প্রয়োজনীয়তা আগেই উপলব্ধি করেছিল। ক্রিস মিলারের মতে, সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশের বাধা এতটাই বেশি যে নতুন কোনো প্লেয়ারের পক্ষে এই মার্কেটে ঢোকা এবং এখানকার প্রতিষ্ঠিত প্লেয়ারদের সাথে প্রতিযোগিতা করা খুব কঠিন। এর কারণ, সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রি খুব কমপ্লেক্স, আর এর সাথে বিপুল বিনিয়োগ জড়িত। শুধু এসব থাকাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রযুক্তিগত ব্যবধান ঘুচাতে না পারার একটি মূল কারণ হল তাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই স্তরের প্রযুক্তি এবং দক্ষতা ছিল না। সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই এগিয়ে ছিল, ফলে তারা পরবর্তীতে বাজারে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজি ছিল না। ফলে তাদের জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এসব ছাড়া সেমিকন্ডাক্টর জগতে এগোনো অসম্ভব।

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ কঠিন হওয়াটা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। প্রথমত, এর কারণে নতুন কোম্পানির জন্য এই বাজারে প্রবেশ করা এবং প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে যায়। এর কারণে এই ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চ এবং প্রতিযোগিতার অভাব দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশে উচ্চ বাধার কারণে বিভিন্ন দেশের পক্ষে নিজেদের জন্য সেমিকন্ডাকটর ইন্ডাস্ট্রি গড়া কঠিন হয়ে যায়। ফলে তাদেরকে সেমিকন্ডাক্টরের জন্য বিদেশী সাপ্লাই চেইনের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এতে সাপ্লাই চেইনে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা তৈরী হয়।

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ কঠিন হওয়া জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও প্রধান উদ্বেগের কারণ। বিভিন্ন মিলিটারি কাজে সেমিকন্ডাক্টর অপরিহার্য। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে অল্প সংখ্যক কোম্পানির আধিপত্যের কারণে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলস্বরূপ, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার সেমিকন্ডাক্টরের জন্য বিদেশী সরবরাহকারীদের উপর তাদের নির্ভরতা কমাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে।

সুতরাং বলা যায়, সেমিকন্ডাকটর চিপ শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তি নয়; বরং পুরো বিশ্বকে বদলে দেওয়ার প্রভাবকও এটি।

What do you think?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

GIPHY App Key not set. Please check settings

ইসলামে রিজিক

ইসলামে রিজিক মানে আমাদের ভাবনার চেয়ে বেশি কিছু

the-philistine-situation-and-what-we-can-do

ফিলিস্তিন পরিস্থিতি এবং আমাদের করণীয়