আমরা আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করি। বাড়ি, গাড়ি, প্লট, ব্যবসা এমনকি আমাদের সন্তানদের উপর বিনিয়োগ করি। কিন্তু আমরা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, অর্থাৎ আমাদের স্ত্রী, বা জীবনসঙ্গীর প্রতি বিনিয়োগ করতে ভুলে যাই।
আমাদের সমাজে একটি সাধারণ চিত্র হলো, বিয়ের সময় আমাদের স্ত্রীর বয়স সাধারণত কম হয়। হয়তো তারা ইন্টারমিডিয়েট, ব্যাচেলরস সম্পন্ন করেছে বা এখনও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, বিয়ের পর তাদের শিক্ষা অনেক সময়েই থেমে যায়, কারণ তারা পরিবারের দায়িত্ব এবং সন্তানের যত্ন নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, পুরুষরা তাদের পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে দেখা যায়, স্বামী অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং স্ত্রী সেই একই অবস্থানে রয়েছেন, ফলে তাদের মধ্যে একটি বিশাল ফাঁক তৈরি হয়।
এই ফাঁক এক সময়ে গিয়ে মিডলাইফ ক্রাইসিস, ঝগড়া এবং নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্বামী প্রায়শই স্ত্রীর প্রতি অভিযোগ করতে শুরু করেন যে তিনি কিছুই বোঝেন না, সমাজে ভালোভাবে মিশতে পারেন না, ইংরেজি জানেন না, এমনকি একা বাইরে যেতেও পারেন না। এই সব পরিস্থিতি তৈরি হয়, কারণ বিয়ের পর স্ত্রীকে তার দক্ষতা এবং শিক্ষার উন্নয়নে সহায়তা করা হয়নি।
স্ত্রীর উপর বিনিয়োগ করা মানে শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়, বরং এটি তার শিক্ষা, মানসিক উন্নতি এবং সক্ষমতার উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। স্ত্রীর সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখা এবং তাকে সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান করা স্বামীর এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাহলে, কেন স্ত্রীর উপর বিনিয়োগ করা উচিত এবং কীভাবে এটি আমাদের জীবনে উপকার বয়ে আনতে পারে?
স্ত্রীর প্রতি বিনিয়োগের সুবিধা
প্রথমত, স্বামীর জীবন এবং সমস্যাগুলো বুঝতে সক্ষম হবে। স্ত্রী যখন স্বামীর সাথে তার অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান শেয়ার করতে সক্ষম হন, তখন তিনি স্বামীর জীবন এবং সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন স্বামী যদি তার স্ত্রীর সাথে ব্যবসায়িক চিন্তা, কাজের চাপ, বা জীবনযাত্রার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেন, তাহলে স্ত্রী সেই সমস্যাগুলো বোঝার এবং সমাধানে সহায়তা করতে সক্ষম হন। এটি তাদের মধ্যে বোঝাপড়া এবং সম্পর্ককে মজবুত করে, যা একটি সুখী ও সুস্থ সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
দ্বিতীয়ত, সন্তানের শিক্ষায় সহায়তা। একজন শিক্ষিত মা তার সন্তানের শিক্ষা এবং নৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। ইসলাম আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে গাইড করার এবং তাদের সঠিক পথে চালিত করার উপর বিশেষ জোর দেয়। হাদিসে আছে, “প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার অধীনস্তদের সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা হবে” (সহিহ বুখারি)। অর্থাৎ একজন মা যদি শিক্ষিত এবং দক্ষ হন, তবে তিনি তার সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করতে সক্ষম হবেন। সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধ মায়ের কাছ থেকেই শুরু হয়, তাই মায়ের শিক্ষিত হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে বহু উদাহরণ রয়েছে। কুরআনে আছে, “তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের বস্ত্রস্বরূপ, আর তোমরা তাদের বস্ত্রস্বরূপ” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৮৭)। এর অর্থ হলো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি পারস্পরিক সম্মান এবং সহানুভূতির সম্পর্ক। তাই স্ত্রীর উন্নতি ও কল্যাণের জন্য বিনিয়োগ করা, তাকে শিক্ষা এবং সুযোগ প্রদান করা, কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখন, স্ত্রীর প্রতি বিনিয়োগ না করলে কী কী সমস্যা হতে পারে? প্রথমত, স্ত্রীর এবং স্বামীর মধ্যে দূরত্ব বাড়বে এবং সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, সন্তানরা তাদের প্রয়োজনীয় গাইডেন্স থেকে বঞ্চিত হবে এবং হয়তো ভুল পথে চলে যেতে পারে। তৃতীয়ত, যদি স্ত্রী অশিক্ষিত বা অদক্ষ থাকেন, তিনি পারিবারিক সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে অক্ষম হতে পারেন, যা বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তবে এই বিনিয়োগটি হবে শরিয়ার গণ্ডির ভেতরে থেকে। কলেজে-ভার্সিটিতে ফ্রিমিক্সিং পরিবেশে নারীদের জন্য স্রেফ সার্টিফিকেট লাভের জন্য শিক্ষার্জন বৈধ নয় – এ ব্যাপারে অধিকাংশ সমসাময়িক আলিমই মত দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে নারীরা কি করতে পারেন?
স্ত্রীর প্রতি বিনিয়োগ করার উপায়
তাকে শিক্ষার সুযোগ প্রদান করতে হবে। স্ত্রীকে তার পছন্দের বিষয়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ প্রদান করুন। ইসলামি জ্ঞান, ফরজ ইলম, নারীসংক্রান্ত মাসাইল, নৈতিকতা, ভাষা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করুন। ঘরে বসেই যেন শিক্ষা অর্জন করা যায় তার ব্যবস্থা করুন। যেমন অনলাইন কোর্স, প্রাইভেট টিউটর, পারিবারিক গ্রন্থাগার ব্যবহার ইত্যাদি।
স্ত্রীর আগ্রহ ও মেধা অনুযায়ী বিভিন্ন দক্ষতা শেখার সুযোগ প্রদান করুন। হাতের কাজ, রান্না, বাজারজাতকরণ, বাচ্চাদের যত্ন, বাগান কর্ম, ব্যবসা, শিল্পকলা ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করুন। প্রশিক্ষণ কোর্স, ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করুন।
স্ত্রীর মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার প্রতি যত্নশীল হোন। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাকে অংশীদার করুন। স্ত্রীর মতামত ও পরামর্শকে গুরুত্ব দিন। তার আবেগ, অনুভূতি ও চাহিদা বোঝার চেষ্টা করুন।
স্ত্রীর সাথে সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করুন। তার পছন্দ-অপছন্দ, পছন্দ, অধিকার ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। ঘরের কাজে স্ত্রীর সাথে ভাগ করে নিন। স্ত্রীর সামনে অন্য নারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন।
স্ত্রীকে ইসলামের নীতিশাস্ত্র, নারীর অধিকার ও কর্তব্য, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করুন। একসাথে বিভিন্ন ইবাদত করুন। স্ত্রীকে নিয়মিত নামাজ পড়তে, কুরআন পাঠ করতে ও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করুন।
আসল কথা হলো, স্ত্রীর প্রতি বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা শুধু আমাদের সম্পর্ককেই মজবুত করি না, বরং আমাদের সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতও নিশ্চিত করি। এটি দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। এই বিষয়ে আমাদের সবার ভাবা উচিত এবং পরিবারের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
GIPHY App Key not set. Please check settings