পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ আমাদেরকে নজরের হিফাজত করতে বলেছেন। যাতে আমরা লজ্জাশীল থাকতে পারি।
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِكَ اَزۡكٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ ﴿۳۰﴾
মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। [সূরা আন-নূর, আয়াত ৩০]
নজর হেফাজতের অর্থ হলো, বিপরীত লিঙ্গের দিকে না তাকানো। তারা দৃষ্টির সামনে পড়লে নজর সরিয়ে নেওয়া। তাদের দিকে খারাপ ইচ্ছা বা কামনা নিয়ে দেখা যাবে না। যদি দেখার মধ্যে কোনো খারাপ ইচ্ছা জাগে, তাহলে সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া উচিত। সাধারণত আমরা মনে করি, কেবল যুবক-যুবতী বা যাদের বিয়ে হয়নি তাদেরকেই নজর হেফাজতে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজকের এই ফিতনা-ফাসাদের দুনিয়াতে বিবাহিত জীবনেও নজর নীচু রাখা খুবই জরুরী। কেবল নজরের হেফাজতে গাফিলতির কারণে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে স্বামী-স্ত্রীরা বিয়ের পরও নজর হেফাজতে রাখেন না, তারা তাদের সম্পর্ককে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।
সোশ্যাল মিডিয়া এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা। আমরা মনে করি, সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর হেফাজত করতে হয় না বা করা যায় না। কিন্তু সর্বক্ষণের সঙ্গী এই সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিম ছেলেমেয়েরা সবাই ব্যাপকভাবে “চোখের জিনা”র ফাঁদে পড়ে আছে। এটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত্তি, অর্থাৎ একে অপরের প্রতি বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের দ্রুত প্রসারের ফলে আমাদের সমাজে এক ধরণের অশান্তি দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে দৃষ্টি এবং এর সাথে সম্পর্কিত আচরণে। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাবে আমরা বিপরীত লিঙ্গের জীবনে যে অসীম প্রবেশাধিকার পেয়েছি, আর এর কারণে যে মানসিক এবং নৈতিক বিপদ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে আমরা কি সচেতন? প্রতিদিনই ইনস্টাগ্রামে ৯৫ মিলিয়ন এবং ফেসবুকে ৩৫০ মিলিয়ন ছবি আপলোড হচ্ছে। একটা ১৩ বছরের শিশু যে পরিমাণ নারীদেহ দেখতে পাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা হয়তো তাদের গোটা জীবনেও এত নারী দেখেনি।
অত্যাধিক পরিমাণে অশ্লীল ছবির এই স্রোত আমাদের মনের উপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। বর্তমান প্রজন্মের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার এই ফিড অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। যারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া কি আদৌ ভালো কোনো মাধ্যম? এই প্রশ্নের গুরুত্ব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রাস্তায় বসা থেকে বেঁচে থাক। লোকেরা বললঃ আমরা এ ধরণের বসা থেকে বঁচতে পারি না; কেননা, সেখানে বসে আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যদি বসা ব্যতীত তোমার গত্যন্তর না থাকে তবে পথের হক আদায় করবে। তারা বললঃ পথের দাবী কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ চক্ষু নত করা, কষ্টদায়ক বিষয় দূর করা, সালামের জবাব দেয়া, সৎকাজের আদেশ করা, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করা। [বুখারীঃ ২৪৬৫, মুসলিমঃ ২১২১]
এই হাদিসটি শুধু রাস্তা বা সড়কপথের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং তথ্যের রাস্তা, ছবির রাস্তা বা ভিডিওর রাস্তার জন্যও প্রযোজ্য। আমি ফেসবুকের নিউজ ফিড, টাইমলাইন, ইউটিউবের হোমপেইজ স্ক্রল করার কথা বলছি। প্রতিটি অ্যাপ্লিকেশন একটি রাস্তা। এই রাস্তায় যা যা দেখবেন সবই আপনার মনের ভেতরে গেঁথে যাবে। তাই এগুলো থেকেও দৃষ্টিকে সংযত করতে হবে।
একজন কবি বলেছেন, “সব আগুনের সূত্রপাত যেমন স্ফুলিঙ্গ থেকে, তেমনি সব বিপদ শুরু হয় দৃষ্টির অবাধ ব্যবহারের মাধ্যমে।”
আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নিশ্চয়ই শ্রবণ, দৃষ্টি এবং হৃদয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সুরা ইসরা: ৩৬)
অতএব, কোনো নারী বা পুরুষ যদি তার নিজের ছবি পোস্ট করে বলে যে ‘কেউ খারাপভাবে তাকাবেন না,’ তাহলে বিষয়টা যুতসই হয় না। যে আল্লাহ দৃষ্টিকে সংযত করার আদেশ দিয়েছেন, তিনিই আপনাকে শালীন পোশাক পরার নির্দেশও দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “মুমিন পুরুষদের বলুন দৃষ্টি সংযত করতে এবং তাদের গোপনাঙ্গের হেফাজত করতে, এটাই তাদের জন্য পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কাজ সম্পর্কে সবই জানেন।” (সুরা নূর: ৩০) পুরুষদের পাশাপাশি একইভাবে নারীদেরও দৃষ্টি সংযত করতে এবং শালীন পোশাক পরিধান করতে বলা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখানো জিনিস সবসময় সত্যি হয় না। ফটো ফিল্টারের মাধ্যমে অনেক কিছু সুন্দর দেখানো হয়। বাস্তবে এত সুন্দর নাও হতে পারে। কিন্তু আমরা বাস্তব অবাস্তব পার্থক্য করতে না পেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখি তা-ই বিশ্বাস করে বসি। ভাবি, ঐ মহিলা কত সুন্দর! অমুক-তমুক নায়িকা কত সুন্দর। তখন আর নিজের স্ত্রীকে ভালো লাগে না। অথচ অমুক-তমুক মহিলার ছবি হাইলি এডিট করে, সকল ত্রুটি মুছে ফেলে এরপরই আপলোড করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দেখে লোভ করা ঠিক না, যা আপনি আসলে পাবেন না। এটা আপনাকে অসুখী করে তুলবে।
নিজের বিবাহিত জীবনে সুখী থাকতে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে নজর হিফাজতে রাখা খুবই জরুরি। ইমাম গাজালি রাহ. বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুদৃষ্টি নিয়ে অন্যের দিকে তাকায়, সে দেখবে যে সে এমন একজনের প্রেমে পড়েছে, যাকে সে কোনোদিনও পাবে না।”
আজকের দুনিয়াতে আমাদের বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে অনেক সময় প্রয়োজনে কথা বলতে হয়। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের জন্য সীমানা বেঁধে দিয়েছেন সেটাও মানতে হবে। ইসলাম আমাদের জীবনযাপনের সঠিক পদ্ধতি শিখিয়েছে। যদি আমরা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সাথে কথা বলার সময় আল্লাহর দেয়া নিয়ম-কানুন গুলো মানি, তাহলে আমরা শয়তানের ফাঁদে পড়ব না। কখনো কখনো সঠিক পথে চলা কঠিন মনে হয়। আমরা সমাজের রীতি মেনে চলার চেষ্টা করি, কিন্তু আমাদের সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নির্দেশ অমান্য করি।
আপনি যখন নজর নীচু রাখবেন, তখন শয়তান আপনার থেকে দূরে থাকবে। খারাপ ইচ্ছাগুলো মনে আসবে না। ইবনুল কাইয়িম রাহ. এর একটা বিখ্যাত কথা আছে:
“চোখ হলো মনের আয়না। যদি কেউ নজর নীচু রাখে, তাহলে তার মনের খারাপ ইচ্ছা কমে যাবে। কিন্তু যদি কেউ চেয়ে থাকে, তাহলে তার মনের খারাপ ইচ্ছা আরো বাড়বে।”
ইবনে মুফলিহ দৃষ্টিকে সংযত করার ব্যাপারে উপদেশ দিয়ে বলেছেন: “বুদ্ধিমান ব্যক্তি হারাম থেকে দৃষ্টি সংযত করে। কারণ সে এমন কিছু দেখে না যা সে কখনোই অর্জন করতে পারবে না এবং যা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়।”
এই উপদেশ আমাদের প্রতিদিনের জীবনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সোশ্যাল মিডিয়ার এই দুনিয়ায় দৃষ্টিকে সংযত করা এবং সতর্ক হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ আমাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখার তাওফিক দিন।
GIPHY App Key not set. Please check settings