মক্কায় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটবে যার দ্বারা বিশ্বব্যাপী মুমিনরা ইঙ্গিত পাবে যে সত্যিকারের ইমাম মাহদি এসেছেন। একজন মুসলিম নেতার মৃত্যুর পর গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে। অনেক দল ক্ষমতার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। মাহদি কিছু লোকের দ্বারা স্বীকৃত হবেন এবং তারা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে খলিফা হতে বাধ্য করবে। তারা মক্কায় কাবাঘরের সামনে তার প্রতি বাইয়াত গ্রহণ করবে।
বাইয়াতের পর সিরিয়া থেকে মাহদি ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালানোর জন্য একটি সেনাবাহিনী পাঠানো হবে। সেই বাহিনীকে মরুভূমিতে গ্রাস করা হবে। ফিরআউনের বাহিনী যেভাবে সমুদ্রে ডুবে মরেছিল, তেমনি এই সেনাবাহিনীও অকস্মাৎ মরুর খাদে পড়ে চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর, সিরিয়া, ইরাক এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মুসলিমরা তাকে সত্য মাহদি হিসাবে স্বীকৃতি দেবে এবং তারা তাদের বাইয়াত প্রদানের জন্য তার কাছে আসবে।
উম্মু সালামাহ রা. সূত্রে বর্ণিত। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يَكُونُ اخْتِلَافٌ عِنْدَ مَوْتِ خَلِيفَةٍ فَيَخْرُجُ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ هَارِبًا إِلَى مَكَّةَ فَيَأْتِيهِ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ مَكَّةَ فَيُخْرِجُونَهُ وَهُوَ كَارِهٌ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ وَيُبْعَثُ إِلَيْهِ بَعْثٌ مِنْ أَهْلِ الشَّامِ فَيُخْسَفُ بِهِمْ بِالْبَيْدَاءِ بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ فَإِذَا رَأَى النَّاسُ ذَلِكَ أَتَاهُ أَبْدَالُ الشَّامِ وَعَصَائِبُ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَيُبَايِعُونَهُ بَيْنَ الرُّكْنِ وَالْمَقَامِ
জনৈক খলিফার মৃত্যুকালে মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। এ সময় মদিনাবাসী জনৈক ব্যক্তি পালিয়ে মক্কায় চলে যাবে। মক্কাবাসীরা তার নিকট এসে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে আসবে এবং তারা রুকন ও মাকামে ইবরাহিমের মাঝখানে তার হাতে বাইয়াত করবে। অতঃপর তার বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে একটি সৈন্যবাহিনী পাঠানো হবে। এদেরকে মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে দেখতে পাবে, তখন সিরিয়ার ধার্মিক ব্যক্তিগণ ও ইরাকবাসীদের কয়েকটি দল তার নিকট এসে রুকন ও মাকামের মাঝখানে তার হাতে বাইয়াত করবে। [সুনানু আবু দাউদঃ ৪২৮৬]
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنْ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ
একটি বাহিনী কাবা ঘরের উপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বের হবে। অতঃপর যখন তারা সমতল মরুপ্রান্তরে (বাইদা) পৌঁছবে, তখন তাদের প্রথম ও শেষ ব্যক্তি সকলকেই জমিনে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। [সহিহ বুখারিঃ ২১১৮]
এই অলৌকিক ঘটনা ছাড়াও সত্যিকারের মাহদির একটি প্রধান লক্ষণ হবে কর্তৃত্ব লাভের ব্যাপারে তাকওয়া ও বিনয়। তিনি ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও খলিফা হতে চাইবে না। এই বিষয়টি তাকে নেতৃত্ব দেওয়ার আরো যোগ্য করে তুলবে। সুন্নত হল, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া নেতৃত্বের পদ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা।
আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ سَمُرَةَ لَا تَسْأَلْ الْإِمَارَةَ فَإِنَّكَ إِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ مَسْأَلَةٍ وُكِلْتَ إِلَيْهَا وَإِنْ أُعْطِيتَهَا عَنْ غَيْرِ مَسْأَلَةٍ أُعِنْتَ عَلَيْهَا
হে আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ! তুমি নেতৃত্ব চেয়ো না। কারণ চাওয়ার পর যদি তোমাকে তা দেয়া হয়, তবে তার দায়িত্ব তোমার উপরই বর্তাবে। আর যদি চাওয়া ছাড়াই তা তোমাকে দেয়া হয় তবে এ ক্ষেত্রে তোমাকে সাহায্য করা হবে। [সহিহ বুখারিঃ ৬৭২৭]
সুতরাং যারা নিজেদেরকে মাহদি বলে দাবি করে এবং এর বিনিময়ে নেতৃত্ব, সম্পদ এবং অন্যান্য পার্থিব লাভ কামনা করে তারা মিথ্যাবাদী ও প্রতারক। প্রকৃত মাহদি নিজেকে মাহদি বলে ঘোষণা করবে না, খলিফা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও করবে না এবং মানুষের কাছে পার্থিব লাভও চাইবে না।
উম্মাহর মধ্যে অনেক ভণ্ড আবির্ভূত হয়েছে যে নিজেকে মাহদি বা ইসা আলায়হিস সালাম কিংবা বিশেষ ধার্মিক ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করেছে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে এই প্রতারকদের সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। বিশেষ করে কিয়ামতের আগে তাদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে।
সাওবান রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّهُ سَيَكُونُ فِي أُمَّتِي ثَلَاثُونَ كَذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِيٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي
আমার উম্মাতের মধ্যে খুব শীঘ্রই ৩০ জন ডাহা মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে। এদের সকলেই দাবি করবে যে সে নবি। অথচ আমিই সর্বশেষ নবি, আমার পরে কোন নবি নেই। [সুনানু তিরমিজিঃ ২২১৯]
আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنْ الْأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلَا آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لَا يُضِلُّونَكُمْ وَلَا يَفْتِنُونَكُمْ
আখেরি জামানায় বহু ধোঁকাবাজ মিথ্যাবাদী আসবে; যারা তোমাদের কাছে এমন এমন হাদিস নিয়ে উপস্থিত হবে, যা তোমরা এবং তোমাদের বাপদাদারাও কোন দিন শ্রবণ করেনি। সুতরাং তোমরা তাদের থেকে সাবধান থেকো; তারা যেন তোমাদেরকে ভ্রষ্টতা ও ফিতনায় না ফেলে। [সহিহ মুসলিমঃ ১৬]
আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
يَخْرُجُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ رِجَالٌ يَخْتِلُونَ الدُّنْيَا بِالدِّينِ يَلْبَسُونَ لِلنَّاسِ جُلُودَ الضَّأْنِ مِنْ اللِّينِ أَلْسِنَتُهُمْ أَحْلَى مِنْ السُّكَّرِ وَقُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الذِّئَابِ
শেষ জামানায় কিছু লোকের উদ্ভব হবে যারা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবে। তারা জনগণের সামনে ভেড়ার চামড়ার মত কোমল পোশাক পরবে। তাদের মুখের ভাষা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি; কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র। [সুনানু তিরমিজিঃ ২৪০৪]
তাই কেউ মাহদি হিসেবে নিজেকে দাবি করলে তার ব্যাপারে সংশয় পোষণ করতে হবে। কারণ প্রকৃত মাহদি নিজেকে মাহদি বলে দাবি করবে না। বরং আল্লাহ অলৌকিক ঘটনা ঘটাবেন, যার ফলে সারা মুসলিম বিশ্ব তাঁর কাছে এসে জমায়েত হবে।
আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আমরা সামাজিক নানা অনাচার দেখেও অনেকেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, কারণ আমরা মনে করি, ইমাম মাহদি আসার আগে দুনিয়ার সমস্যার কোনো সমাধান হবে না, মুসলিমরা পরাজিত জাতি হিসেবেই দুনিয়ায় অবস্থান করবে। কিন্তু মাহদির ভবিষ্যদ্বাণী অকর্মণ্য মুসলিম হওয়ার অজুহাত হিসেবে খাড়া করা যাবে না, তাদের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে থাকা যাবে না।
শায়খ আলবানি রাহ. বলেছেন,
لا يجوز للمسلمين أن يتركوا العمل للإسلام وإقامة دولته على وجه الأرض انتظاراً منهم لخروج المهدي ونزول عيسى عليهما السلام يأساً منهم أو توهماً أن ذلك غير ممكن قبلهما
ইমাম মাহদি ও ইসা আলায়হিস সালামের আগমনের অপেক্ষায় থাকা, হতাশ হয়ে এই ভাবা যে তাদেরকে ছাড়া মুসলিমরা ইসলামের পক্ষে কোনো অগ্রগতি করতে পারবে না কিংবা পৃথিবীতে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না – এটা একটা ভুল ধারণা। [ফিকহু আশরাতুস সাআহঃ ৩১১]
এই আলোচনায় আমরা দেখলাম, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে মাহদি, তার নিদর্শন এবং শেষ জামানায় কি কি হবে সে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনায় আমাদের বলেছেন। উদ্দেশ্য হল, বিশ্বের পট পরিবর্তনকারী বড় বড় ঘটনাগুলোর জন্য আমাদের প্রস্তুত করা। সেইসাথে আমাদেরকে মিথ্যা নবী এবং প্রতারকদের থেকে রক্ষা করা যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য ধর্মের অপব্যাখ্যা করে, একে হাতিয়ার বানায়।
এ ছাড়া মাহদির জন্য অপেক্ষায় থেকে ভালো কাজ করার ব্যাপারে আমাদের উদাসীন হওয়াও কাম্য নয়। বরং, আমাদের নিজেদের ইমান-আমলের মেহনত করতে হবে, মুসলিম সম্প্রদায় থেকে শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটনে কাজ করতে হবে। যাতে ইমাম মাহদি ও ইসা আলায়হিস সালাম আগমন করলে আমরা যথাযথভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। মাহদিকে দেখার পর মুমিনদের তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে, সকল প্রকার সহায়তা করতে হবে, এমনকি তাঁর কাছে হিজরত করে যেতে হবে। যদি আগামীকালকেই মাহদির আবির্ভাব ঘটে, আপনি কি এসব করার জন্য প্রস্তুত আছেন?
আল্লাহ আমাদেরকে সরল পথে অটল রাখুন, ভণ্ড-প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা করুন। দ্বীনদার তাকওয়াবান মুসলিমদের সংস্পর্শে রাখুন।
** আবু আমিনা ইলিয়াসের (জাস্টিন প্যারট) “Al-Mahdi, the promised Caliph to lead the Ummah” অবলম্বনে রচিত।
GIPHY App Key not set. Please check settings