এক সহজ সুন্দর সকালে। সুমন চাচা তার গ্রামের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছেন। চা খেতে খেতে তিনি পত্রিকা পড়ছেন। পত্রিকায় লেখা আছে দেশের নতুন বাজেট নিয়ে। কিভাবে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ গুলো আরো এগিয়ে যাবে। সুমন চাচা পত্রিকার এই খবর পড়ে খুব খুশি হলেন। মনে মনে ভাবলেন, সরকার তো অনেক ভালো কাজ করছে। এমন সময় পাশের বেঞ্চে বসে থাকা রহিম মিয়া বললেন, “চাচা, তোমার এই পত্রিকায় যা লেখা থাকে সব কি বিশ্বাস করা যায়?”
সুমন চাচা একটু অবাক হয়ে রহিম মিয়ার দিকে তাকালেন। “কেন, কি বলছো তুমি?” তিনি প্রশ্ন করলেন।
রহিম মিয়া বললেন, “গণমাধ্যম এমনভাবে তথ্য প্রচার করে যে আমরা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারি না আমাদের মতামত আসলে কিভাবে গড়ে উঠছে।”
সুমন চাচা মাথা নেড়ে বললেন, “তুমি একটু খোলসা করে বলো তো, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
রহিম মিয়া শুরু করলেন, “ধরো, একটা কোম্পানি আছে যারা অনেক দূষণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু তারা বড় বড় পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের স্পন্সর। এখন এই গণমাধ্যমগুলো কি সেই কোম্পানির দূষণের খবর প্রচার করবে? বরং তারা সেই কোম্পানির ভালো কাজগুলোকে সামনে নিয়ে আসবে। আর আমরাও বিশ্বাস করবো যে কোম্পানিটা খুব ভালো কাজ করছে।”
সুমন চাচা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক বলেছো রহিম। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাহলে সত্যটা কিভাবে জানবে?”
রহিম মিয়া হাসলেন, “সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে চাচা। আমাদের জানতে হবে যে গণমাধ্যম সব সময় নিরপেক্ষ নয়। তাদেরও নিজেদের স্বার্থ আছে। অনেক সময় তারা আমাদের মনের মধ্যে মিথ্যা ধারণা ঢুকিয়ে দেয় যাকে বলা হয় ‘সম্মতি উৎপাদন’।”
সুমন চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “এখনও ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না বিষয়টা।”
রহিম মিয়া মাথা নেড়ে বললেন, “দাঁড়াও বলছি। ধরো, আমাদের গ্রামে একটা বড় প্রকল্প নেওয়া হলো, যেখানে অনেক বড় বড় কারখানা তৈরি হবে। সরকার বলছে এতে অনেক কর্মসংস্থান হবে, উন্নয়ন হবে। আমরা সবাই খুশি। কিন্তু প্রকল্প শুরু হওয়ার পর আমরা দেখতে পেলাম আমাদের গ্রামের নদীটা দূষিত হয়ে গেছে, পানি খাওয়া যাচ্ছে না। মাছ মরে যাচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু পত্রিকায় লেখা হলো, এই প্রকল্পে গ্রামের মানুষ কত উপকৃত হচ্ছে, কিভাবে গ্রাম বদলে যাচ্ছে। নদীর দূষণ নিয়ে কিছুই লেখা হলো না। আমাদের কণ্ঠ সেখানে শোনা গেল না।”
সুমন চাচা মাথা নেড়ে বললেন, “বুঝলাম রহিম, আমরা শুধু যা দেখি বা পড়ি, তার ওপর নির্ভর করে সব সময় সত্যিটা জানতে পারি না। আমাদের নিজেদেরও খোঁজ খবর নিতে হবে।”
রহিম মিয়া হাসলেন, “ঠিক তাই চাচা। গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক বড়, কিন্তু আমাদেরও দায়িত্ব আছে।”
সুমন চাচা গভীর চিন্তায় পড়লেন। চায়ের দোকানে বসে তিনি বুঝলেন, শুধু পত্রিকার খবর পড়ে সব সময় সত্যিটা জানা যায় না। আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে, জানতে হবে কিভাবে গণমাধ্যম আমাদের সম্মতি তৈরি করে, এবং সত্যের খোঁজে নিজেকে সচেষ্ট রাখতে হবে।
আমরা এই গল্পে সম্মতি উৎপাদন ও মিডিয়ার ধোঁকার কথা জানলাম। এই বিষয়ে অনবদ্য একটি বই হচ্ছে নোয়াম চমস্কির ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইটি। এই বইয়ে গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন এবং রাজনৈতিক শক্তির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এই বইটি চমস্কির রাজনৈতিক চিন্তা এবং যোগাযোগের পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বইটি লেখক এডওয়ার্ড সায়িদের সাথে যৌথভাবে লিখেছেন এবং এটি মূলত দুটি প্রধান থিসিসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে: গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং এটি কীভাবে জনমত এবং সংস্কৃতি প্রভাবিত করে।
চমস্কি এবং সায়িদের তত্ত্ব মতে, গণমাধ্যম একটি শিল্প এবং ব্যবসার অংশ যা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির স্বার্থে কাজ করে। গণমাধ্যম এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে তথ্য প্রেরিত হয়, তা সাধারণ জনগণের মনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট ধরনের সম্মতি তৈরি করতে সহায়ক। এই প্রক্রিয়াটি তথাকথিত “সম্মতি উৎপাদন” নামক একটি ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
চমস্কি দাবি করেন যে গণমাধ্যম মূলত একটি বৃহৎ প্রপাগান্ডা মেশিন। এটি জনগণের চিন্তাধারা, মতামত এবং আচরণকে একটি নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করতে প্রভাবিত করে। গণমাধ্যমের প্রচারিত তথ্য এবং বিশ্লেষণ শর্তাধীনভাবে সরকারের, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির, এবং অন্যান্য প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলির স্বার্থে মোড়ানো থাকে। এতে করে জনগণ ন্যায়বিচার ও প্রকৃত সত্য সম্পর্কে প্রভাবিত হয় এবং তারা একটি মিথ্যা বা অসত্য চিন্তাধারা গড়ে তোলে।
চমস্কি এবং সায়িদের মতে, গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি উৎপাদন করা হয়। এটি মূলত একটি ধাপ-বাই-ধাপ প্রক্রিয়া যেখানে সংবাদ ও তথ্যের মাধ্যমে জনগণের মনের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বার্তা স্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কৌশলগুলির মধ্যে রয়েছে:
১. গণমাধ্যম কিছু নির্দিষ্ট খবরকে প্রচার করে এবং কিছু খবরকে এড়িয়ে যায়। এর ফলে, জনগণ কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়, কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে বঞ্চিত থাকে। উদাহরণ হিসেবে, ধরুন একটি বড় কর্পোরেট কোম্পানি একটি নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা করছে এবং এর জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে। গণমাধ্যমে শুধুমাত্র এই প্রকল্পের উন্নয়নমূলক দিকগুলো, যেমন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া, দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পটি পরিবেশে কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে, যেমন দূষণ বৃদ্ধি বা স্থানীয় প্রাণীর ক্ষতি, এসব তথ্য খুব কম প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে, জনগণ শুধুমাত্র ইতিবাচক দিকগুলো জানতে পারছে এবং প্রকৃত ক্ষতির প্রতি উদাসীন থেকে যাচ্ছে।
২০১৪ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ও ভোটাধিকার ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের কিছু অংশ প্রধানত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারণা এবং নির্বাচনের ফলাফলের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। তবে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সহিংসতা এবং ভোট কারচুপির ঘটনা নিয়ে খবরের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এর ফলে জনগণ নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারেনি। এভাবে, গণমাধ্যম কিছু তথ্যকে প্রচার করে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করে, যার ফলে জনগণ সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারছে না।
২. গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচারিত বার্তাগুলি প্রায়ই সরকারী বা কর্পোরেট স্বার্থের সঙ্গে মিল রেখে গঠিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্বাচনী প্রচারে একটি রাজনৈতিক দল তাদের সাফল্য এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলোর প্রশংসা করে প্রচার চালায়। তারা তাদের প্রচারণায় এমন সব অর্জন তুলে ধরে যা আসলে বাস্তবতায় সীমিত, কিন্তু বার্তা এতটা দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে জনগণ এটি সঠিক মনে করে। অন্যদিকে, তাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো কখনোই গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয় না। এইভাবে, গণমাধ্যম জনগণের মনে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে যা রাজনৈতিক দলটির স্বার্থকে পূরণ করে।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রচারিত বার্তাগুলির একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেখা গেছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের অর্জন এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলির প্রচার করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে তারা বিশাল অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিতর্ক এবং সঙ্কট ছিল, যা প্রধানত প্রচারণার সময় সরাসরি আলোচনা হয়নি। সরকারী অর্জনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হলেও, নির্বাচনী সুষ্ঠতা ও স্বচ্ছতার অভাবকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
৩. বিকল্প তথ্যের অভাবে জনগণের কাছে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি জানা থাকে না। উদাহরণ হিসেবে, ধরুন একটি আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ বা যুদ্ধের সময়, গণমাধ্যমের অধিকাংশ অংশ যুদ্ধের প্রভাব এবং সরকারী অবস্থানকে প্রচার করে। তবে, সাধারণত যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বা শান্তি প্রস্তাবকারী পক্ষের বক্তব্য প্রচারিত হয় না।
বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো। অনেক সময় গণমাধ্যমগুলি সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি বা শাসকদলের অবস্থানকে সমর্থন করে। বিকল্প মতামত বা সমালোচনা গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়, যা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করে। এই পরিস্থিতিতে, বিকল্প তথ্য বা সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, ফলে জনগণ শুধুমাত্র একপেশে তথ্য পেয়ে থাকে এবং তাদের চিন্তাভাবনা বৈচিত্র্যময় হতে পারে না।
সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, গণমাধ্যম শুধু তথ্যই পরিবেশন করে না, বরং এটি জনগণের চিন্তাধারা এবং মতামতও গড়ে তোলে। তাই জনগণকে সতর্ক হতে হবে, জানতে হবে বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। চোখকান সর্বদা খোলা রাখতে হবে।
GIPHY App Key not set. Please check settings