সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন ২৬ সেপ্টেম্বর নিয়ে ভরে গেছে। এই তারিখটিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আলোচনা, গুজব ও উৎসুকতা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ দাবি করছেন, এই দিনে তারা ধনী হয়ে যাবেন। আবার কেউ কেউ নতুন গাড়ি কিনবেন এমন পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু কেন? মূলত এর পেছনে আছে হ্যামস্টার কমব্যাট নামের একটি গেইম।
১. হ্যামস্টার কমব্যাট কি?
হ্যামস্টার কমব্যাট জনপ্রিয় ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামভিত্তিক একটি গেইম। এই গেইমটি ২০২৪ সালের মার্চে চালু হওয়ার পর মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ এই গেইম খেলে ফেলেছে।
হ্যামস্টার কমব্যাট অ্যাপ খেলোয়াড়দের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে বিনামূল্যে ৬ মিলিয়ন টোকেন উপার্জন করার সুযোগ দেয়। খেলোয়াড়রা হ্যামস্টার আইকনে ট্যাপ করে কয়েন খনন করে এবং মোর্স কোডের পাঠোদ্ধার করে বা সঠিক কম্বো কার্ড নির্বাচন করে অতিরিক্ত পুরস্কার জিততে পারে।
হ্যামস্টার কমব্যাট বা এই ধরনের অন্যান্য ক্রিপ্টো গেইমগুলো সাধারণত একটি ক্লিকার গেইম হিসেবে কাজ করে, যেখানে খেলোয়াড়দের মূল কাজ হলো গেমের ভিতরে বিভিন্ন ক্লিক বা ইনভেস্টমেন্ট করা।
২. গেইমটি কিভাবে কাজ করে?
- প্রাথমিক কাজ: গেমে শুরুতে একটি ছোট্ট হ্যামস্টার হিসেবে খেলতে হয়, যার কাজ হলো একটি কল্পিত ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করা।
- বিনিয়োগ এবং আপগ্রেড: খেলোয়াড়কে গেমে বিভিন্ন অপশনে বিনিয়োগ করতে হয়, যেমন: মার্কেটিং, দক্ষ কর্মী নিয়োগ, নতুন পণ্য তৈরি, লাইসেন্স কেনা ইত্যাদি। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে আপনি আপনার এক্সচেঞ্জের মুনাফা বাড়াতে পারেন।
- ইন–গেইম মুদ্রা (Hamster Coins): প্রতিটি সফল বিনিয়োগ বা আপগ্রেডের মাধ্যমে আপনি Hamster Coins অর্জন করেন, যা গেমের ভেতরে একটি ভার্চুয়াল মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- দৈনিক পুরস্কার এবং ইভেন্ট: গেমে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার দেওয়া হয়, যেমন: আপনি যদি গেমের নির্দিষ্ট কোনো আপগ্রেড বা ইনভেস্ট করেন, তাহলে আপনি বিনামূল্যে ৫ মিলিয়ন হ্যামস্টার কয়েন পেতে পারেন।
- টোকেন এবং এয়ারড্রপ: মূল আকর্ষণ হলো গেমের Hamster Kombat (HMSTR) টোকেন। এই টোকেনগুলো গেমে খেলার জন্য বা বিভিন্ন বিনিয়োগের মাধ্যমে জেতা যায়। এরপর এয়ারড্রপের মাধ্যমে এই টোকেনগুলো খেলোয়াড়দের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
৩. খেলোয়াড় কেন টাকা পায়?
গেইমটি থেকে প্রকৃত অর্থ (যা টোকেন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে পায়) আসলে গেমের Hamster Kombat (HMSTR) টোকেনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। খেলোয়াড়েরা এই টোকেনগুলো বিভিন্ন কাজের জন্য পায়:
- গেমে বিভিন্ন প্রজেক্টে বিনিয়োগ করে।
- নির্দিষ্ট সময় ধরে গেইম খেলে।
- গেমের বিভিন্ন মিশন বা দৈনিক টাস্ক সম্পন্ন করে।
এই টোকেনগুলো পরে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে বিক্রি বা ট্রেড করা যায়, যার মাধ্যমে খেলোয়াড়রা বাস্তব টাকা পেতে পারে।
৪. ২৬ তারিখে কি হবে?
গেইমটি এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে এর টোকেন Hamster Kombat (HMSTR) এখন বিভিন্ন ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে প্রি-মার্কেটে ট্রেড করা যাচ্ছে। এর মানে হলো, বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের আগেই খেলোয়াড়রা এই টোকেন কিনতে-বিক্রি করতে পারবে।
জুলাই ২০২৪-এ, গেমের নতুন হোয়াইটপেপার প্রকাশিত হয়, যেখানে HMSTR টোকেনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বরে হ্যামস্টার কমব্যাট (HMSTR) টোকেনের টোকেন জেনারেশন ইভেন্ট (TGE) এবং এয়ারড্রপ অনুষ্ঠিত হবে। এই দিন গেমের খেলোয়াড়দের মধ্যে গেমের ভার্চুয়াল মুদ্রা HMSTR টোকেন বিতরণ করা হবে। গেমের টোকেনের মোট সরবরাহের ৬০% খেলোয়াড়দের মধ্যে বিনামূল্যে (এয়ারড্রপের মাধ্যমে) বিতরণ করা হবে।
এই টোকেন হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি, যা ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে বিক্রি বা ট্রেড করা যায়। তাই কেউ গেমে সফলভাবে খেললে এবং টোকেন জিতলে ২৬ তারিখে HMSTR টোকেনগুলো পাওয়া যাবে। এই টোকেনগুলো আপনি পরে ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে বিক্রি করে আসল টাকায় রূপান্তর করা যাবে।
তবে টোকেনের মূল্য বাজারে নির্ভর করে উঠানামা করতে পারে, তাই আসল টাকার পরিমাণ নির্ভর করবে টোকেনের সেই সময়কার বাজারমূল্যের ওপর।
৫. গেইমটির রেভিনিউ মডেলটা আসলে কি?
অনলাইন গেমের মাধ্যমে দ্রুত টাকা আয়ের প্রতিশ্রুতি সাধারণত ধোঁকাবাজির ফাঁদ হয়ে থাকে। এই ধরনের গেইমগুলো সাধারণত প্রথমে আকর্ষণীয় অফার দিয়ে খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করে, যেমন বিনামূল্যে ক্রিপ্টো টোকেন বা টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তবে বাস্তবে এই টোকেনগুলোর মূল্য খুব কম হয়, বা বাজারে বিক্রি করার সুযোগ পাওয়া যায় না। অনেক সময় গেইমগুলো এয়ারড্রপের নামে টোকেন দেয়, কিন্তু সেই টোকেন আসলে মূল্যহীন। গেমের মূল লক্ষ্য হতে পারে আপনার তথ্য সংগ্রহ করা, বিজ্ঞাপন দেখিয়ে আয় করা অথবা আপনাকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। এ ছাড়া, কিছু গেইম পিরামিড স্কিমের মতো কাজ করে, যেখানে নতুন খেলোয়াড় আনলে লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। সহজ কথায়, খালি ক্লিক করে অর্থ উপার্জন সম্ভব নয়। এ ধরনের মডেলগুলো সাধারণত টেকসই বা লাভজনক হয় না।
৬. মুসলিমদের করণীয় কি?
ইসলামে উপার্জনকে হালাল ও হারাম হিসেবে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই বিধান ইসলামি অর্থনীতির মৌলিক নীতিগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে কোনো ধরনের উপার্জন হালাল হতে হলে তা অবশ্যই সৎ, ন্যায়সংগত ও নীতিগতভাবে সঠিক হওয়া উচিত। ইসলামে রিজিক বা উপার্জন এমন কাজের মাধ্যমে হতে হবে যা সরাসরি কোনও কার্যকর বা সেবামূলক মূল্য প্রদান করে। এতে কোনো ধরনের প্রতারণা, মিথ্যা বা মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ইসলামে অর্থনীতি পরিচালিত হয় তিনটি প্রধান নীতির উপর:
১. ইনসাফ (ন্যায়): ব্যবসা বা উপার্জনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা এবং সমতা নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো প্রকারের অন্যায় বা প্রতারণামূলক উপায় ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করা ইসলামে হারাম।
২. রিস্ক বা গ্যাম্বলিং (জুয়া) থেকে বিরত থাকা: জুয়া বা গ্যাম্বলিং এমন একটি উপার্জন পদ্ধতি, যেখানে লাভ বা ক্ষতি একেবারেই অনিশ্চিত এবং এতে মানুষের শ্রম ও মেধার কোনও অবদান থাকে না। যে কোনো ধরনের জুয়া বা বাটপারির মাধ্যমে উপার্জন হারাম।
৩. উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা হতে হবে শুদ্ধ ও সৎ পথে। হারাম উপায়ে উপার্জন যেমন প্রতারণা, মিথ্যা প্রচারণা ও গেম্বলিং ইসলামিক অর্থনীতির মূলনীতির পরিপন্থী। উপার্জনের উৎস সৎ না হলে তা হালাল হতে পারে না।
ইসলামি অর্থনীতিতে প্রতিটি উপার্জন ন্যায্য ও সঠিক হওয়া আবশ্যক, এবং প্রতারণা বা অনিশ্চয়তা থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গারার বা অনিশ্চয়তার যে ধারণা ইসলামে রয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করে কেন কিছু উপার্জন হারাম হয়। গারার হলো এমন কোনো লেনদেন বা চুক্তি যেখানে মূল বিষয়টি অস্বচ্ছ থাকে, এবং তা লোকদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
৬.১. গারার (অনিশ্চয়তা) সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা
কুরআন ও হাদিসে বারবার গারারের ক্ষতি ও অনৈতিকতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
“হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না, তবে তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা হয় তা বৈধ।”
— (সূরা আন-নিসা, ৪:২৯)
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, অন্যায় ও প্রতারণামূলক উপায়ে উপার্জন নিষিদ্ধ এবং সৎ ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবসা হালাল উপার্জনের একমাত্র পথ। গেইমবেইট, গ্যাম্বলি কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ উপার্জন করলে ন্যায়সঙ্গত সেবার পরিবর্তে প্রতারণা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গারার এবং অনিশ্চয়তাপূর্ণ ব্যবসা নিয়ে বেশ কিছু হাদিসে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন:
“যে ব্যক্তি গারার (অনিশ্চিত) ব্যবসা করে, সে হারাম উপার্জন করছে।“
— (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পরিষ্কারভাবে অনিশ্চিত বা গারারভিত্তিক লেনদেনকে নিষিদ্ধ করেছেন। যেসব গেইম বা মডেল শুধুমাত্র ক্লিক করলেই টাকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়, তাতে সুনির্দিষ্টভাবে কী উপার্জিত হবে তা অনিশ্চিত থাকে সেটি গারারের একটি উদাহরণ। এমন কোনো প্রতিযোগিতা বা গেইম যেখানে প্রকৃত পণ্য বা সেবার বদলে শুধু ক্লিকের ভিত্তিতে পুরস্কার দেওয়া হয়, তা গারার হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ইসলামি অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ হবে।
৬.২. হালাল ও হারামের স্পষ্টতা
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেছেন:
“নিশ্চয়ই হালাল ও হারাম স্পষ্ট। আর এ দুটির মাঝে কিছু সন্দেহপূর্ণ বিষয় আছে, যা অনেক মানুষ জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকে, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলোতে জড়ায়, সে হারামে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে।”
— (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিস অনুসারে, কোনো কিছু যদি হালাল বা হারাম হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ বা দ্বিধা থাকে, তবে তা থেকে দূরে থাকা উত্তম। অনেক অনলাইন গেইম বা ক্লিকবেইট আয়ের মডেলে প্রাথমিকভাবে আকর্ষণ থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে এগুলোতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং গারার থাকে। তাই সন্দেহপূর্ণ এবং প্রতারণামূলক কোনো গেমে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
৬.৩ গারারের উদাহরণ এবং ক্ষতিকর প্রভাব
গারার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যেখানে একজন মানুষ তার কষ্টার্জিত সম্পদকে (হ্যামস্টার কমব্যাটের ক্ষেত্রে সময় এবং টাকা উভয়ই) একটি অনিশ্চিত পথে বিনিয়োগ করে, যা পুরোপুরি ভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল। যেমন, অনলাইন গেইম যেখানে শুধুমাত্র ক্লিক করলেই অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সেখানে প্রকৃত পণ্য বা সেবা নেই, এবং এই ধরনের লেনদেন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এর ফলে খেলোয়াড়রা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটি গেম্বলিং বা জুয়ার মতোই ক্ষতিকর।
ইসলাম স্থিতিশীল ও নৈতিক উপার্জনের জন্য উৎসাহ দেয়, যেখানে প্রতিটি লেনদেনের ভিত্তি স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত হয়। গারার এবং ধোঁকাবাজির মাধ্যমে উপার্জন স্পষ্টতই হারাম, এবং ইসলামিক অর্থনীতিতে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, উপার্জনকে হতে হবে সৎ, ন্যায়সঙ্গত এবং মিথ্যা বা প্রতারণামুক্ত। গারার এবং অনিশ্চিত আয়ের উপায়গুলো ইসলামে হারাম। কারণ এতে কোনও প্রকৃত শ্রম বা সেবা নেই, বরং এটি শুধুমাত্র মিথ্যা আশা ও প্রতারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। সুতরাং, যে কোনো ধরনের গেইম বা মডেল যেখানে গারার ও অনিশ্চয়তা থাকে, তা থেকে বিরত থাকা ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোঝার ও মানার তাওফিক দান করুন। আমিন।
GIPHY App Key not set. Please check settings