অন্তরের কঠোরতা এবং এর শাস্তি সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা জানার চেষ্টা করব এ সংক্রান্ত ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্বে।
সাকিব – বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক মেধাবী ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই দীনের নিয়মকানুন মেনে বেড়ে উঠেছে সে। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসী একজন মানুষ। নিয়মিত নামাজ, দান-সদকা, সকল ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে চলত সে। তার মুখে থাকতো সবসময় আল্লাহর কথা, মনে থাকতো পরকালের ভয়। কিন্তু আজকের সাকিব অনেকটা বদলে গেছে। নামাজে মনোযোগ নেই, দান-সদকার প্রবণতাও কমে গেছে। আল্লাহর প্রতি ভয় যেন তার হৃদয় থেকে উঠে গেছে। কুরআন পাঠ কিংবা তিলাওয়াত শোনা, কোনোটাই যেন তার ভেতর প্রভাব ফেলে না।
এই পরিবর্তনের কারণ কী? সাকিবের মনের ভেতরে কী ঘটছে?
সাকিবের মতো অনেক মানুষ আজকের দুনিয়ায় দেখা যায়, যাদের অন্তর ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। আল্লাহর প্রতি ভয়, দয়া, সহানুভূতি – এই সকল মানবিক গুণাবলী যেন তাদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে।
أَفَمَنْ شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَى نُورٍ مِنْ رَبِّهِ فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন ফলে সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের উপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?) অতএব ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আল্লাহর স্মরণ থেকে। তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত। [সুরা আয-যুমারঃ ২২]
এই আয়াতটি সূরা আয-যুমার থেকে উদ্ধৃত, যার অর্থ “সৈন্যদল”। এটি বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য এবং আল্লাহর স্মরণের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করে।
“আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন” – আল্লাহ কিছু মানুষের হৃদয়কে ইসলাম গ্রহণের জন্য, দীনের পথে চলার জন্য উন্মুক্ত করেন। তিনি তাদেরকে সত্য বুঝতে এবং সঠিক পথ অনুসরণ করতে সহায়তা করেন।
“সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের উপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?)” – এখানে বোঝা যাচ্ছে যে যারা আল্লাহর দ্বারা পরিচালিত তাদের জীবনে আলো এবং স্পষ্টতা রয়েছে। তারা সন্দেহ ও বিভ্রান্তির অন্ধকারে হারিয়ে যায় না।
“অতএব, যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে কঠিন হয়ে গেছে তাদের জন্য দুঃখ!” – এখানে আল্লাহ তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছেন তাদের প্রতি যারা তার স্মরণ থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের হৃদয় কঠিন এবং অজ্ঞান হয়ে গেছে, যার ফলে তারা সত্য গ্রহণ করতে অক্ষম।
“তারা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় রয়েছে।” – এই শেষ বাক্যটি তাদের ভবিষ্যতের পরিণতি স্পষ্ট করে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তারা চিরস্থায়ী বিপদে নিপতিত হবে।
এই আয়াতে অন্তরের কঠিনতার আলোচনা এসেছে। অন্তরের কঠিনতার কারণ কী? এর প্রভাব কী কী? কীভাবে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? এই প্রশ্নগুলো নিয়েই আলোচনা করবো এই প্রবন্ধে।
অন্তরের কঠোরতার শাস্তি
পবিত্র কুরআনে অন্তরের কঠোরতার নিন্দা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوۡبُكُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِكَ فَهِیَ كَالۡحِجَارَۃِ اَوۡ اَشَدُّ قَسۡوَۃً ؕ
অতঃপর তোমাদের অন্তরসমূহ এর পরে কঠিন হয়ে গেল যেন তা পাথরের মত কিংবা তার চেয়েও শক্ত। [সুরা বাকারাঃ ৭৪]
এরপর আল্লাহ অন্তরের কঠোরতার কারণ উল্লেখ করেছেন,
وَ اِنَّ مِنَ الۡحِجَارَۃِ لَمَا یَتَفَجَّرُ مِنۡهُ الۡاَنۡهٰرُ ؕ وَ اِنَّ مِنۡهَا لَمَا یَشَّقَّقُ فَیَخۡرُجُ مِنۡهُ الۡمَآءُ ؕ وَ اِنَّ مِنۡهَا لَمَا یَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡیَۃِ اللّٰهِ ؕوَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۷۴﴾
আর নিশ্চয় পাথরের মধ্যে কিছু আছে, যা থেকে নহর উৎসারিত হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা চূর্ণ হয়। ফলে তা থেকে পানি বের হয়। আর নিশ্চয় তার মধ্যে কিছু আছে যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে। আর আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে গাফেল নন। [সুরা বাকারাঃ ৭৪]
আল্লাহর অসংখ্য মুজিযা এবং মৃতকে পুনরুজ্জীবনের মত অলৌকিক ঘটনা সাক্ষ্যাত করেও যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ঈমানের আলো জ্বলে ওঠে না, বরং তাদের হৃদয় পাথরের চেয়েও কঠিন হয়ে যায় – তাদের জন্য কতই না দুঃখ!
এই কঠিন হৃদয়ের কারণে ঈমানের স্পর্শ ও সত্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়। এমন মানুষের সংশোধনের সম্ভাবনা ক্ষীণ, বরং ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
اَلَمۡ یَاۡنِ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡ تَخۡشَعَ قُلُوۡبُهُمۡ لِذِكۡرِ اللّٰهِ وَ مَا نَزَلَ مِنَ الۡحَقِّ ۙ وَ لَا یَكُوۡنُوۡا كَالَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡكِتٰبَ مِنۡ قَبۡلُ فَطَالَ عَلَیۡهِمُ الۡاَمَدُ فَقَسَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ ؕ وَ كَثِیۡرٌ مِّنۡهُمۡ فٰسِقُوۡنَ ﴿۱۶﴾
যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি ? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতঃপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারপর তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে গেল। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক। [সুরা আল-হাদীদ: ১৬]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন,
اَفَمَنۡ شَرَحَ اللّٰهُ صَدۡرَهٗ لِلۡاِسۡلَامِ فَهُوَ عَلٰی نُوۡرٍ مِّنۡ رَّبِّهٖ ؕ فَوَیۡلٌ لِّلۡقٰسِیَۃِ قُلُوۡبُهُمۡ مِّنۡ ذِكۡرِ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓئِكَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۲﴾
আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ খুলে দিয়েছেন ফলে সে তার রবের পক্ষ থেকে নূরের উপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়?) অতএব ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আল্লাহর স্মরণ থেকে। তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত। [সুরা যুমারঃ ২২]
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য গ্রহণ করার এবং সঠিক পথ অবলম্বন করার সুমতি লাভ করেছে, অতঃপর সে তার অন্তরের প্রশস্ততার কারণে আল্লাহর দ্বীনের আলোর উপর প্রতিষ্ঠিত, সে কি ঐ ব্যক্তির সমান হতে পারে, যার অন্তর ইসলামের প্রতি কঠোর, তার বক্ষ সংকীর্ণ এবং ভ্রষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
প্রসিদ্ধ তাবিয়ি মুনযির ইবনু মালিক রাহ. বলেছেন, “আসমানি কিতাবের জ্ঞানের অধিকারী কঠোর অন্তরের হলে তার চেয়ে অধিক কঠোর হৃদয়ের কেউ হতে পারে না।”
হাদিসে অন্তরের কঠোরতার নিন্দা
১. ইবনু উমার রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاَ تُكْثِرُوا الْكَلاَمَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ فَإِنَّ كَثْرَةَ الْكَلاَمِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللَّهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ وَإِنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللَّهِ الْقَلْبُ الْقَاسِي
আল্লাহ তাআলার যিকির ছাড়া বেশী কথা বলো না। কেননা আল্লাহ তাআলার যিকির ছাড়া বেশী কথা বললে অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আর নিঃসন্দেহে কঠিন অন্তরের লোকই আল্লাহ তাআলা থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে থাকে। [জামি তিরমিজিঃ ২৪১১]
২. আনাস ইবনু মালিক রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
চারটি জিনিস দুর্ভাগ্যের অন্তর্ভুক্তঃ
১. (অন্তরের কঠোরতার দরুণ) অশ্রু শুকিয়ে যাওয়া
২. অন্তর কঠোর হওয়া
৩. আশা-আকাঙ্খা দীর্ধ হওয়া এবং
৪. দুনিয়ার প্রতি লোভ থাকা।
সালাফের বক্তব্যে অন্তরের কঠোরতার নিন্দা
১. মালিক ইবনু দীনার রাহ. বলেছেন: “একজন বান্দার জন্য অন্তরের কঠিনতার চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু নেই।” [জামি বায়ান আল-ইলম ওয়া ফাযলিহি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৬৫]
GIPHY App Key not set. Please check settings